সেরা বই রিভিউ | উল্টো নির্ণয়

সেরা বই রিভিউ : উল্টো নির্ণয়

লেখক: মোহাম্মদ তোয়াহা আকবর

১।
বইটা হাদিয়া পাই। যিনি দিয়েছিলেন তিনি আমার খুব কাছের এক ভাই। বইতে কিছু কম্পলিমেন্ট লিখে দেন আরজুকে নিয়ে। তখনো আরজু পৃথিবীর আলো বাতাস দেখেনি। হাদিয়া পাওয়া এই বইয়ের কম্পলিমেন্ট সযত্নে রেখেছি।

২।
যেহেতু নতুন লেখক তাই লেখকের একটু পরিচয় দেই।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালীন সময়ে লেখকের কয়েকটি গবেষণার কাজ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। নিজের বিভাগ, ফ্যাকাল্টিসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ রেজাল্টের কারণে সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদানের মাধ্যমে তাঁর প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের স্বীকৃতি ও সম্মান দেন।

উল্টো নির্ণয়
উল্টো নির্ণয়

৩।
বইয়ের নামটাই কতো ইন্টারেস্টিং, উল্টো নির্ণয়! বইয়ের প্রথম অনুচ্ছেদ একটা গল্প দিয়ে,গল্পেত দাম মাত্র ১৫ টাকা।
রিক্সাভাড়া দিতে গিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ খুলে দেখেন ৫০০ টাকার নোট ছাড়া আর কোনো ভাংতি টাকা নাই।এরকম মুহূর্তে যাকেই বলেন, "ভাই ভাংতি হবে?" তারা হাসিমুখে বলেন, "সরি ভাই,ভাংতি নাই।" তাদের হাসি দেখে মনে হয় যেনো ভাংতি না থাকাটা এক মহাআনন্দের বিষয়!

তখনই একজন অপরিচিত লোক এসে পকেট থেকে ১৫ টাকা বের করে রিক্সাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দেন।

লেখক বলেন, এই ১৫ টাকা অর্থাৎ একটা ১০ টাকা আর একটা ৫ টাকার নোট কত ছোট্ট! কত ক্ষুদ্র! কিন্ত সেটা দিয়ে সাহায্য করতে আসার পেছনের মনটা কত বিশাল বড়, তাইনা?
আমি নিজে হলে কি এরকম সাহায্য করতাম?

৪।
গাড়িতে চলার সময় রাস্তায় পাশাপাশি বড় বড় ৬-৭ টা গর্ত থাকলে আমরা যেমন অনবরত ঝাঁকুনি খাই সেই ঝাঁকুনির ধাক্কায় আমাদের মাথা অনবরত নড়তে থাকে... বইটা পড়ার সময় আমি কয়েকবার এরকম অনবরত ঝাঁকুনি খেয়েছি।

দু একটা উদাহরণ দেই:
সত্য পরম নাকি আপেক্ষিক?

অর্থাৎ আগেকার মানুষ বিশ্বাস করতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে,আর পৃথিবী সমতল।

আর এখন বিজ্ঞানের বদৌলতে আমরা জানতে পেরেছি সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে না বরং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে।আর পৃথিবী সমতল না,গোলাকার।

তাহলে আগেকার মানুষের কাছে যেটা সত্য ছিলো এখনকার মানুষের কাছে তা মিথ্যা। তার মানে সত্য পরম না বরং আপেক্ষিক,তাইনা?

কিন্ত লেখক প্রমাণ করেন,সত্য আপেক্ষিক না বরং সত্য পরম কিন্ত বিশ্বাস আপেক্ষিক।মানুষের বিশ্বাস ভুল হতে পারে কিন্ত সত্য কখনো ভুল বা মিথ্যা হতে পারেনা।
যেমন: ২+৩=৫ সেটা এ যুগেও যেমন সত্য, আদিমযুগের জন্যও সত্য।এখন যদি কেউ বিশ্বাস করে ২+৩=৪ তাহলে সেটা তার ভুল ধারণা ভুল বিশ্বাস।
ডেভিড হিউমের The Principle of Empirical Verifiability'র মাধ্যমে লেখক প্রমাণ করেন সত্যের সার্বজনীনতা।

৫।
বাংলা সিনেমায় নায়ক মাথায় আঘাত খাবার পর যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন আশেপাশের সবার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,আমি কে? আমি এখানে কেন?

বাস্তব জীবনেও যে আমরা অসংখ্যবার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি সেটা লেখক বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন।

বাচ্চাবয়সে আমরা বিছানা ভিজাতাম, মানুষের কোলে উঠলে হিশু করতাম তবুও মানুষ আমাদেরকে কোলে নিতো।আজ আমরা বড় হয়েছি, আমরা আর বিছানা ভিজাই না, মানুষের কোলে উঠলেও হিশু করতাম না তবুও কেন মানুষ আমাদেরকে কোলে নেয়না?

এর উত্তর অত্যন্ত হাস্যরসের মাধ্যমে লেখক দিয়েছেন।

ছোটবেলার নিজের একটা ছবির সাথে এখনকার একটা ছবির যে পার্থক্য যা দেখে আমরা নিজেরা বিষ্মিত হই তার বৈজ্ঞানিক কারণ লেখক দেখিয়েছেন ম্যাক্রো ইভ্যালুশন নামের কনসেপ্ট দিয়ে।

৬।
বলা হয়ে থাকে বইয়ের মধ্যে দর্শন যত বেশি থাকবে পাঠক চিন্তার সাগরে তত বেশি হাবুডুবু খাবে।

বইয়ের মধ্যে লেখক একটা গল্প বলা শুরু করেন। গল্পের মধ্যভাগ শেষ করে বাকি গল্পটা শেষ করার দায়িত্ব দেন পাঠকের কাধে। পাঠক যেনো এই জায়গায় এসে নিজের মতো করে চিন্তাকরে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে গল্পটা শেষ করে।

সেটা না পারলে লেখক শেষাংশে ঐ গল্পগুলোর সমাপনী নিজেই করেছেন যারা চিন্তা করে গল্পটা শেষ করতে পারেনি।

মজার ব্যাপার হলো এই গল্পগুলো আমরা প্রত্যেকেই কমপক্ষে ১০০ বার শুনছি। কিন্ত লেখক এমন একভাবে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে গল্পগুলোর প্লট তৈরি করেছেন,মনে হয়েছে এগুলো নতুন কোনো গল্প।

গল্পের শেষটা দেখে মনে হলো লেখক কিভাবে পাঠককে নিয়ে খেলছেন!

৭।
প্যালিন্ড্রোম(Palindrome) বা কিছু শব্দ যেগুলোর সামনে এবং পেছন থেকে যেদিকেই পড়া হোক না কেন, একইরকম অক্ষর পাওয়া যায়।
যেমন: রামাকান্ত কামার, A lad named E. Mandala এরকম তথ্য নিয়ে লেখক অনেক মজার মজার গল্প বলেছেন।
পবিত্র কোরআনের প্যালিন্ড্রোম। বইটার মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট আমার কাছে এটাই মনে হয়েছে।

৮।
বইয়ের শেষের দিকের একটা অনুচ্ছেদ 'কিছু কষ্ট-কথা' শিরোনামে।এই অনুচ্ছেদের ৭ টা বাস্তবধর্মী ছোট গল্প। যাদের অন্তর পাথর হয়ে যায়নি তারা এই অনুচ্ছেদটা পড়ার পর হয়তো দেখতে পাবে চোখের কোণে জমে আছে কয়েক ফোটা অশ্রু। কিন্ত সত্য কথা হলো, পত্র-পত্রিকায় এরকম খবরই আমরা দেখি কিন্ত ঐগুলো দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এমনভাবে যে,সেগুলো পড়ার পর আর চোখে অশ্রু আসেনা।

ভাবলাম এই লেখক যদি পত্রিকায় ঐসব নিউজ লিখতেন তাহলে প্রতিদিন এদেশের মানুষ ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলে একবার কান্না করতো! ভাগ্যিস উনি সাংবাদিক নন!

৯।
বইটি ছোট ছোট অনুচ্ছেদে বিভক্ত।অনুচ্ছেদগুলোর নামও ইন্টারেস্টিং। যেমন : মধ্যবিত্ত পাথর পিতা,প্রিয় লেজ,থইথই ভালোবাসা জাগাবো বলে,বোতল,একজন চেনা শিক্ষকের অচেনা কথা,কবে শিখবো ভালোবাসতে?জীবন্ত মিরাকল।

১০।
বইটি সম্পর্কে আলোড়নসৃষ্টিকারী লেখক আরিফ আজাদ ভাই মন্তব্য করেছেন, 'উল্টো নির্ণয়' বইটি আপনাকে উল্টো করে সত্যকে নির্ণয় করে দেখাবে যে সত্য কতোটা সহজাত আর সুন্দর হয়।

[রিভিউটা কয়েকমাস আগের লিখা, প্রথম অনুচ্ছেদটা এডিট করে পোস্ট করেছি।
ছবি : সংগৃহীত।

-আরিফুল ইসলাম

Comments

Popular posts from this blog

মেমোরি সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন | মেমোরির সাতকাহন

বই রিভিউ | আফ্রিকী দুলহান